ভূমিকা
রমজান মাস। আরবি মাসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অপরিসীম। দুনিয়ার কোনো সম্পদের সঙ্গে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না। রমজানের আগমনে বিশ্বনবি অনেক আনন্দিত হতেন। সাহাবাদের উদ্দেশ্যে এভাবে ঘোষণা দিতেন বিশ্বনবি সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-
أتاكم رمضان شهر مبارك
‘তোমাদের দরজায় বরকতময় মাস রমজান এসেছে।’

 

রমজান মাস কেন গুরুত্বপূর্ণ
তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের ঘোষণা দিয়ে এ মাসের বিশেষ ফজিলত বর্ণনা করতেন। আর তা ছিল এমন-
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ (বাধ্যতামূলক) করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের (নবি-রাসুলের উম্মতের) ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

 

রমজান মাসের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা

১. ফরজ রোজা পালন
রমজান মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এ মাসজুড়ে রোজা পালন করা ফরজ। কুরআনুল কারিমের রোজা পালনের নির্দেশ এসেছে এভাবে-
فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)

 

২. কুরআন নাজিলের মাস
রমজান মাস-ই হল সেই মাস; যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

 

৩. জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার মাস
রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। রমজানের সম্মানে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ মাসর বরকত লাভে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের আবদ্ধ করে রাখা হয়।’ (বুখারি, মুসলিম)

 

৪. লাইলাতুল কদরের মাস
এ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘লাইলাতুল কদর’। রাতটি হাজার মাসের (৮৩ বছর ৪ মাস) ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতে কুরআনুল কারিম নাজিল করা হয়েছে। রমজানের শেষ দশকের বেজোড় যে কোনো একটি রাতই ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ- وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ – لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ – تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ – سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
‘আমি একে (কুরআনকে) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন কি লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা কদর : আয়াত ১-৫)

 

৫. দোয়া কবুল হওয়ার মাস
রমজান মাসের দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন বলে জানিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে-
‘রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর সমীপে দোয়া করে। আর তা কবুল হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহামদ)

 

৬. জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস
এ মাসকে তিন দশকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে শেষ দশক হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘আল্লাহ তাআলা (রমজান মাসের) প্রতি রাত ও দিনে অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা করেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের বেলায় প্রত্যেক মুসলমানের দোয়া ‘মোনাজাত’ কবুল হয়ে থাকে।’ (মুসনাদে আহামদ)

 

এ মাসে আমাদের করণীয় আমল

রমজান মাসে কিছু বিশেষ আমল করা উচিত। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল এবং সেগুলো কীভাবে করা উচিত তার উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. রোজা পালন

করণীয়: ফজরের আগ থেকে মাগরিব পর্যন্ত পানাহার এবং সকল প্রকার অপবিত্র কাজ থেকে বিরত থাকা।

কীভাবে করবেন:

  • সেহরি: ফজরের আজান শুরুর আগে রাতের শেষ ভাগে হালকা খাবার খেয়ে নিন।
  • নিয়ত: রোজা রাখার জন্য অন্তরে নিয়ত করুন। যদিও উচ্চারণের প্রয়োজন নেই, তবে অনেকে আরবি ভাষায় নিয়ত করেন: “নাওয়াইতু আন আসুমা সাওমা শাহরি রামাদানা মিনাল ফাজরি ইলাল মাগরিবি ইমানান ওয়া ইহতিসাবান”।
  • ইফতার: মাগরিবের আজান হলে ইফতার করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, আপনি খেজুর, পানি বা অন্য কোনো হালকা খাবার দিয়ে ইফতার করতে পারেন।

২. তারাবিহ নামাজ

করণীয়: ইশার নামাজের পর অতিরিক্ত ২০ রাকাত নামাজ পড়া।

কীভাবে করবেন:

  • ইশার নামাজ পড়া: প্রথমে ইশার নামাজ পড়ে নিন।
  • তারাবিহ নামাজ: প্রতি দুই রাকাত করে সালাম ফিরিয়ে মোট ২০ রাকাত নামাজ আদায় করুন। কেউ কেউ ৮ রাকাতও পড়ে থাকেন। মসজিদে জামাতে পড়লে সবচেয়ে ভালো।
  • দুআ: নামাজ শেষে দুআ করুন এবং আল্লাহর নিকট নিজের এবং অন্যান্য মুসলমানদের জন্য মাগফিরাত ও রহমত প্রার্থনা করুন।

৩. কুরআন তিলাওয়াত

করণীয়: কুরআন মাজিদ পাঠ করা এবং এর অর্থ অনুধাবন করা।

কীভাবে করবেন:

  • দৈনিক সময় নির্ধারণ: প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময় নির্ধারণ করুন কুরআন তিলাওয়াতের জন্য, যেমন ফজরের পর বা মাগরিবের পর।
  • অর্থসহ পড়া: যদি সম্ভব হয়, তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের অর্থ পড়ুন এবং তা অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ঈমান বৃদ্ধি পাবে।

৪. ইফতার ও সেহরি

করণীয়: সময়মত ইফতার ও সেহরি করা, এবং দুআ কবুলের সময় হওয়ায় দুআ করা।

কীভাবে করবেন:

  • ইফতার: মাগরিবের আজান শোনামাত্র ইফতার করুন। ইফতারের পূর্বে দুআ করুন: “আল্লাহুম্মা ইন্নি লাকা সুমতু ওয়া বিকা আমানতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতর্তু”।
  • সেহরি: ফজরের আগমনের কিছুক্ষণ আগে হালকা খাবার গ্রহণ করুন এবং সেহরির দুআ করুন: “নাওয়াইতু আন আসুমা গাদান মিন শাহরি রমাদানা হাদাস সানাতি লিল্লাহি তা’আলা”।

৫. লাইলাতুল কদরে ইবাদত

করণীয়: লাইলাতুল কদরের রাতে ইবাদত করা।

কীভাবে করবেন:

  • ইবাদত: শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে বেশি বেশি নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, দুআ করা, এবং আল্লাহর স্মরণ করা।
  • নফল নামাজ: নফল নামাজ পড়তে পারেন, যেমন তাহাজ্জুদ নামাজ।
  • দুআ: বিশেষ করে এই রাতে দুআ করুন। একটি গুরুত্বপূর্ণ দুআ হলো: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি”।

রমজান মাসে এই বিশেষ আমলগুলো পালন করলে আপনি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবেন এবং নিজের ইমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করতে পারবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের বরকতপূর্ণ আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দিন। আমিন।

 

উপসংহার
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের ফজিলত ও বিশেষ বেশিষ্ট্যগুলো যথাযথভাবে পালনের তাওফিক দান করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভে তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

প্রশ্ন ও উত্তর


প্রশ্ন ১: রমজান মাসে কুরআন নাজিল কেন বিশেষ গুরুত্ব রাখে?
উত্তর: কুরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজান মাসে আল্লাহ মানুষের হেদায়েতের জন্য কুরআন নাজিল করেছেন, যা সত্যপথের নির্দেশিকা।

 

প্রশ্ন ২: রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ কেন?
উত্তর: রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে যাতে মানুষ মুত্তাকি হতে পারে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।

 

প্রশ্ন ৩: লাইলাতুল কদর কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: লাইলাতুল কদর হল হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম রাত, এ রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে এবং এতে দোয়া কবুল হয়।

 

প্রশ্ন ৪: রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে যায় কেন?
উত্তর: রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দিয়ে এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে আল্লাহ রোজাদারদের সম্মানিত করেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখেন।

 

প্রশ্ন ৫: রমজান মাসে কোন ইবাদতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি?
উত্তর: রমজান মাসে রোজা রাখা, কুরআন তিলাওয়াত, তারাবিহ নামাজ, ইফতার ও সেহরি এবং লাইলাতুল কদরের ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

 

আরো পড়ুন

 

জানাজার নামাজের পদ্ধতি ও দোয়া: সহজবোধ্য ব্যাখ্যা

ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম ও নিয়ত: তাকবিরের গুরুত্ব