ভূমিকা
ইসলামের আগমনের পূর্বে, নারীদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। আরব সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম নিলে পরিবারে দুঃখের ছায়া পড়ত এবং অনেক সময় এমনকি কন্যাসন্তান হত্যা করা হতো। কিন্তু ইসলাম এই বর্বর প্রথাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই নিবন্ধে, আমরা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করব এবং কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে তার প্রমাণ উপস্থাপন করব।
১. শিক্ষাগত অধিকার
ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআন শরিফের সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে কোরআন শরিফের আগমন শুরু হয়, যেখানে জ্ঞান অর্জনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোরআনে বলা হয়েছে:
“যারা জানে (জ্ঞানী) আর যারা জানে না (জ্ঞানী নয়) তারা কি সমান?”
(সুরা জুমার, আয়াত: ৯)
মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।”
(ইবনে মাজাহ)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, নারীদেরও শিক্ষার অধিকার রয়েছে এবং এটি তাদের জন্যও একটি মৌলিক কর্তব্য।
২. অর্থনৈতিক অধিকার
ইসলামে নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীদের পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা হয়নি। তারা যদি অর্থ উপার্জন করে, তা সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। কোরআনে বলা হয়েছে:
“পুরুষরা যা উপার্জন করে তা তাদের প্রাপ্য অংশ, আর নারীরা যা উপার্জন করে তা তাদের প্রাপ্য অংশ।”
(সুরা নিসা, আয়াত: ৩২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আল্লাহ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন।”
(বুখারি)
এটি নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে।
৩. উত্তরাধিকারের অধিকার
ইসলাম নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের অধিকার প্রদান করেছে। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর ন্যায়সংগত অধিকার আছে, তেমনি স্ত্রীদেরও অধিকার আছে পুরুষদের ওপর।”
(সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)
নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তিতে অংশীদার হতে পারে এবং বিয়েতে মোহরানা (দেনমোহর) দ্বারা সম্পত্তি লাভ করতে পারে।
৪. পরকালীন কল্যাণের অধিকার
ইসলামে নারীদের পরকালীন কল্যাণের অধিকারও রয়েছে। কোরআনে উল্লেখ আছে:
“আর যে সৎকাজ করবে সে পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে ঈমানদার হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
(সুরা নিসা, আয়াত: ১২৪)
“পুরুষ বা নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, যদি সে মুমিন হয় তাহলে তাকে আমি দুনিয়াতে পবিত্র জীবন যাপন করাব এবং পরকালের জীবনেও এদের সৎকর্মের বিনিময়ে উত্তম পুরস্কার দেব।”
(সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭)
৫. কন্যা হিসেবে নারীর অধিকার
ইসলাম কন্যাসন্তান হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে:
“তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না; তাদের এবং তোমাদেরও আমি রিজিক (আহার) প্রদান করি। তাদের হত্যা করা মহাপাপ।”
(সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩১)
মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি তার কন্যাসন্তানের কারণে কোনোরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করলে তারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে আবরণ হবে।”
(তিরমিজি)
৬. স্ত্রী হিসেবে নারীর অধিকার
ইসলামে স্ত্রীর অধিকারও পুরুষের সমান মর্যাদার। কোরআনে বলা হয়েছে:
“পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর ন্যায়সংগত অধিকার আছে, তেমনি স্ত্রীদেরও অধিকার আছে পুরুষদের ওপর।”
(সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৮)
মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: “তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে জীবনযাপন করবে।”
(সুরা নিসা, আয়াত: ১৯)
৭. মাতা হিসেবে নারীর অধিকার
কোরআনে পিতা-মাতার প্রতি সৎ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
“আর ইবাদত করো আল্লাহর, শরিক করো না তার সঙ্গে অন্য কাউকে, আর পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কোরো।”
(সুরা নিসা, আয়াত: ৩৬)
৮. নারীর পছন্দমতো বিয়ের অধিকার
ইসলাম নারীদের তাদের পছন্দমতো বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন:
“কোনো বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না।”
(বুখারি)
৯. নারীর অপবাদ থেকে সুরক্ষার অধিকার
অপবাদ থেকে নারীদের সুরক্ষার জন্য কোরআনে বলা হয়েছে:
“যারা সতী-সাধ্বী নারীর ওপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে এবং এর স্বপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারে, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না।”
(সুরা নুর, আয়াত: ৪)
উপসংহার
ইসলাম নারীজাতিকে তাদের মর্যাদা ও অধিকার প্রদানে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। এই ধর্মের মাধ্যমে নারীরা শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, উত্তরাধিকার, এবং সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার পেয়েছে। প্রখ্যাত অমুসলিম মনীষী পিয়েরে ক্রাবাইট ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “Muhammad was the world’s greatest champion of women’s rights the world has ever seen.” অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) নারী অধিকার প্রদানে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
FAQ
১. ইসলামে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার কী?
জ্বি, ইসলাম নারীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করেছে। কোরআন ও হাদিসে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
২. কি পরিমাণ অধিকার নারীদের অর্থনৈতিক বিষয়ক?
নারীদের অর্থ উপার্জনের অধিকার রয়েছে এবং তারা তাদের উপার্জিত সম্পদ সম্পূর্ণভাবে নিজের হিসেবে ধারণ করতে পারে।
৩. নারীদের উত্তরাধিকারের অধিকার কেমন?
নারীরা পিতা-মাতা, স্বামী, এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সম্পত্তিতে অংশীদার হতে পারে এবং এ বিষয়ে ইসলামে স্পষ্ট বিধান রয়েছে।
৪. পরকালীন কল্যাণে নারীদের সমান অধিকার আছে কি?
হ্যাঁ, নারীদের পরকালীন কল্যাণের অধিকার পুরুষদের মতোই সমান। সৎকাজের মাধ্যমে নারীরাও জান্নাত লাভের অধিকারী।
আরো পড়ুন