ভূমিকা
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আল্লাহর সঙ্গে মুমিনদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে এবং আত্মপূরণের একটি বিরল সুযোগ প্রদান করে। হজের মাধ্যমে মুসলমানরা তাঁর অশেষ কৃপা এবং ক্ষমার আশায় একত্রিত হয়।যারা সামর্থ্য রাখে তাদের জন্য হজ ফরজ।
রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সঠিকভাবে হজ পালন করেন, তিনি আগের সব গুনাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে যাবেন।
এখানে হজ পালনের বিস্তারিত নিয়ম-কানুন আলোচনা করা হয়েছে।
ইসলামে হজের গুরুত্ব
হজ ইসলামের অপরিহার্যত্ব সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“وَأَذِنْنَا لِلنَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ”
(সুরা আল-হাজ্জ, ২২:২৭)
অর্থ: “মহান আল্লাহ মানুষের কাছে হজ পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা আসবে হাঁটতে অথবা দূরবর্তী স্থান থেকে উটের পিঠে চড়ে।”
রাসূল (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় হজ পালন করে এবং সে হজে কোন অশ্লীলতা বা গুনাহ করেনি, সে যেন নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।”
(বুখারি, হাদিস: ১৫৯৭)
হজ আদায় করার শর্তাবলী
হজ আদায় করার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। কুরআন ও হাদিসে এসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে:
- আর্থিক সামর্থ্য: কুরআনে উল্লেখ রয়েছে: “وَأَذِنْنَا لِلنَّاسِ بِالْحَجِّ” (সুরা আল-হাজ্জ, ২২:২৭)। অর্থাৎ, হজ পালনের জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকা আবশ্যক।
- শারীরিক সুস্থতা: রাসূল (সা.) বলেছেন: “যদি কোন ব্যক্তি হজের জন্য সক্ষম না হয়, তবে তাকে হজ পালন করতে হবে না।”
(বুখারি, হাদিস: ১২৩২)
হজের সময়
হজের নির্দিষ্ট সময় ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত। কুরআনে বলা হয়েছে:
“وَأَذِنْنَا لِلنَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ”
(সুরা আল-হাজ্জ, ২২:২৭)
অর্থ: “আমরা মানুষকে হজ পালনের অনুমতি দিয়েছি। তারা আসবে হাঁটতে অথবা দূরবর্তী স্থান থেকে উটের পিঠে চড়ে।”
রাসূল (সা.) বলেছেন: “হজের দিন হলো ৮ম জিলহজ থেকে ১২তম জিলহজ পর্যন্ত।”
(বুখারি, হাদিস: ১৫৯৮)
হজের সম্পূর্ণ নিয়ম
হজ ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা মক্কায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে পালন করতে হয়। এর নিয়ম-কানুন সম্পূর্ণভাবে পালন করা এক মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য।
এই প্রবন্ধে আমরা হজের ফরজ ও ওয়াজিব, তালবিয়া, ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ, হজের প্রকার ও নিয়ত, তাওয়াফ ও সায়ীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করব।
১. হজের ফরজ ও ওয়াজিব গুলি
হজের ফরজ:
১. ইহরাম বাঁধা: হজের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মক্কায় প্রবেশ করার আগে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম বাঁধার সময় নিয়ত করা জরুরি।
২. উ’কুফে আরাফা: আরাফাতের ময়দানে ৯ই জিলহজ সারা দিন অবস্থান করা ফরজ।
৩. তাওয়াফুয যিয়ারাত: হজের সময়ে কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার তাওয়াফ করা ফরজ।
হজের ওয়াজিব:
১. সাফা ও মারওয়া সায়ী: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব।
২. মুযদালিফায় অবস্থান: ৯ই জিলহজ সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মুযদালিফায় কিছু সময় অবস্থান করা ওয়াজিব।
৩. জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনার শয়তান পাথর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
৪. দমে শোকর: হজে তামাত্তু ও কিবরান কারীরা দমে শোকর করা ওয়াজিব।
৫. চুল কাটা: ইহরাম খুলে মাথার চুল কাটা ওয়াজিব।
৬. তাওয়াফে বিদা: মক্কার বাইরের লোকদের জন্য বিদায় তাওয়াফ করা ওয়াজিব।
২. তালবিয়া
তালবিয়া হল হজ বা উমরার জন্য ইহরাম বাঁধার সময় উচ্চারিত বিশেষ দোয়া।
আরবী: “لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ”
উচ্চারণ: “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়া নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছি। আপনার কোনো অংশীদার নেই। সমস্ত প্রশংসা, সম্পদ ও আধিপত্য আপনারই।”
৩. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ
ইহরাম অবস্থায় কিছু নিষিদ্ধ কাজ রয়েছে যা হজ বা উমরার মাহাত্ম্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
১. সেলাইযুক্ত কাপড় বা জুতা পরা।
২. মাথা বা মুখমণ্ডল ঢাকা।
৩. পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।
৪. চুল কাটা বা ছিড়ে ফেলা।
৫. নখ কাটা।
৬. ঘ্রাণযুক্ত তেল বা আতর ব্যবহার করা।
৭. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস।
৮. যৌন উত্তেজনামূলক আচরণ।
৯. শিকার করা।
১০. ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ করা।
১১. শরীরে সাবান লাগানো।
১২. কোনো জীবজন্তু হত্যা করা।
৪. হজের প্রকার ও নিয়তসমূহ
হজের প্রকার:
- ইফরাদ: শুধুমাত্র হজের জন্য ইহরাম বাঁধা।
নিয়ত: “اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ الْحَجَّ فَيَسِّرْهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِنِّي”
বাংলা: “হে আল্লাহ, আমি হজের জন্য ইহরাম বাঁধলাম। এটিকে সহজ করে দিন এবং কবুল করুন।
- কিবরান: হজ এবং উমরাহ একসঙ্গে পালন করা।
নিয়ত: “اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ الْعُمْرَةَ فَيَسِّرْهَا لِي وَتَقَبَّلْهَا مِنِّي”
বাংলা: “হে আল্লাহ, আমি হজ ও উমরাহ একসঙ্গে পালন করার জন্য ইহরাম বাঁধলাম। এটিকে সহজ করে দিন এবং কবুল করুন।”
- তামাত্তু: পৃথকভাবে হজ এবং উমরাহ পালন করা।
নিয়ত: “اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ التَّمَتُّعَ فَيَسِّرْهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِنِّي”
বাংলা: “হে আল্লাহ, আমি তামাত্তু করার জন্য ইহরাম বাঁধলাম। এটিকে সহজ করে দিন এবং কবুল করুন।”
৫. হজের নিয়ত
হজের নিয়ত: “اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ الْحَجَّ فَيَسِّرْهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِنِّي”
বাংলা: “হে আল্লাহ, আমি হজ পালনের জন্য ইহরাম বাঁধলাম। এটিকে সহজ করে দিন এবং কবুল করুন।”
৬. তাওয়াফের বিবরণ
হজের সময় কাবার চারপাশে সাতবার তাওয়াফ করা হয়।
তাওয়াফের নিয়ম:
১. শরীর পাক-সাফ রাখা ও অজু করা। ২. তাওয়াফের শুরুতে হাজের আসওয়াদ (কালো পাথর) এর দিকে মুখ করে শুরু করা। ৩. এক নাগাড়ে সাতবার তাওয়াফ করা। ৪. তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত নামাজ পড়া।
৭. তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী
১. হাজের আসওয়াদ চুম্বন: সম্ভব হলে হাজের আসওয়াদ চুম্বন করা অথবা দূর থেকে ইশারা করা।
দোয়া: “بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ”
২. এযতেবা করা: ইহরামের চাদর দুই কাঁধের নিচ দিয়ে ডান বগলের নিচ দিয়ে ফেলে দেওয়া।
৩. রমল করা: প্রথম তিন চক্করে হেলেদুলে চলা।
৮. তাওয়াফের নিয়ত
তাওয়াফের নিয়ত: “اللَّهُمَّ إِنِّي أُرِيدُ الطَّوَافَ بِبَيْتِكَ الْحَرَامِ فَيَسِّرْهُ لِي وَتَقَبَّلْهُ مِنِّي”
বাংলা: “হে আল্লাহ, আমি আপনার ঘরের চারপাশে তাওয়াফ করার জন্য নিয়ত করেছি। এটিকে সহজ করে দিন এবং কবুল করুন।”
৯. সায়ীর নিয়ম
সায়ীর নিয়ম:
সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত সাতবার দৌড়ানো বা হাঁটা। প্রথম তিন চক্করে পুরুষদের জন্য দ্রুত চলা সুন্নত, বাকি চার চক্কর সাধারণ গতিতে।
১০. সায়ীর সহজ দোয়া
সাধারণ দোয়া: “سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيمِ”
বাংলা: “সব প্রশংসা আল্লাহর, সকল সম্পদ আল্লাহর, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ মহান। কোনো শক্তি নেই আল্লাহ ছাড়া।”
১১. সায়ীর কুরআনি দোয়া
কুরআনি দোয়া: “إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَن حَجَّ الْبَيْتَ أَوْ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا”
(সুরা আল-বাকারাহ, ২:১৫৮)
বাংলা: “নিশ্চিতভাবেই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। যে ব্যক্তি হজ বা উমরাহ করবে তার জন্য এখানে সায়ী করার কোনো অপরাধ নেই।”
এই নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে হজ পালন করা নিশ্চিতভাবে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করতে সহায়তা করবে।
হজ না করলে গুনাহ
হজ পালন করা ফরজ। যদি কেউ হজ পালন না করে এবং তার সামর্থ্য থাকলেও, সে গুনাহের মধ্যে পড়ে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“وَأَذِنْنَا لِلنَّاسِ بِالْحَجِّ”
(সুরা আল-হাজ্জ, ২২:২৭)
অর্থ: “আমরা মানুষকে হজ পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছি।”
রাসূল (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করে, তার মৃত্যু ইহুদি অথবা খ্রিস্টান হয়ে যাবে।”
(বুখারি, হাদিস: ১৫৯৯)
উপসংহার
হজ মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ।
এটি পালন করার মাধ্যমে একজন মুসলমান তার ইমানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে।
যারা সামর্থ্য রাখে তাদের জন্য হজ পালন করা ফরজ, এবং যারা না করে তারা গুনাহের মধ্যে পড়ে।
FAQ
- হজের জন্য কি শুধুমাত্র আর্থিক সামর্থ্য প্রয়োজন?
- হ্যাঁ, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা ও নিরাপত্তারও প্রয়োজন।
- হজ পালনের জন্য কি পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য একি নিয়ম?
- হ্যাঁ, হজের নিয়ম সকল মুসলমানের জন্য অভিন্ন, তবে নারীদের জন্য কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে যেমন মাহরামসহ হজ পালন করা।
- হজের সময় কিভাবে তাওয়াফ করতে হয়?
- তাওয়াফ করতে গিয়ে হজের আসওয়াদ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে সাতবার চক্কর দিতে হয়।
- ইহরাম বাঁধার সময় কি নিষিদ্ধ কাজ রয়েছে?
- হ্যাঁ, ইহরাম বাঁধার সময় সেলাইযুক্ত কাপড় পরা, চুল কাটার মতো কিছু নিষিদ্ধ কাজ রয়েছে।
- যদি কেউ হজ পালনে ব্যর্থ হয়, তার কি করতে হবে?
- যদি কেউ হজ পালনে ব্যর্থ হয় এবং তার সামর্থ্য থাকলেও, তাকে তওবা করতে হবে এবং আগামী বছর হজ পালনের চেষ্টা করতে হবে।