ভূমিকা

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। বছরে দুটি ঈদ উদযাপিত হয়—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এই দিনগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যখন ঈদের দিন আসে, আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন।” (মুসলিম

এছাড়াও, আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, 

“তোমাদের আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)

তবে অনেকেই নিয়ম-কানুন এবং তাকবিরের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন। এই নিবন্ধে ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম, নিয়ত এবং তাকবিরের গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

 

ঈদের নামাজ কেন পড়তে হবে

ঈদের নামাজ আদায় করা ইসলামী বিধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেছেন, “ঈদের নামাজ আদায় করাই উত্তম, এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যম।” (সহীহ বুখারী

কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)

 

ঈদের নামাজের ফজিলত এবং কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ

ঈদের নামাজের ফজিলত অনেক। এই নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিফলন ঘটায়।

 

কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ:

সুরা আল-আ’লা:

আরবি: “قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِۦ فَصَلَّىٰ بَلْ تُؤْثِرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا وَٱلْءَاخِرَةُ خَيْرٌۭ وَأَبْقَىٰٓ إِنَّ هَـٰذَا لَفِى ٱلصُّحُفِ ٱلْأُولَىٰ صُحُفِ إِبْرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ”

উচ্চারণ: “কাদ আফলাহা মান তাযাক্কা ওয়া যাকারাসমা রাব্বিহি ফাসাল্লা, বাল তুউসিরুনাল হায়াতাদ দুনিয়া ওয়াল আখিরাতু খাইরাও ওয়া আবকা।”

অর্থ: “নিশ্চয়ই সে সফল, যে পবিত্রতা অর্জন করেছে, আর তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করেছে, অতঃপর নামাজ পড়েছে। কিন্তু তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবন উত্তম এবং স্থায়ী।” (সূরা আল-আ’লা: ১৪-১৭)

 

সুরা তওবা:

আরবি: “فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ”

উচ্চারণ: “ফাসাল্লি লিরাব্বিকা ওয়ানহার।”

অর্থ: “তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কুরবানি কর।” (সূরা তওবা: ২)

হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ:

হাদিস:

আরবি: “عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: ‘صلاة الرجل في جماعة تزيد على صلاته في سوقه وبيته بضعا وعشرين درجة، وذلك أن أحدهم إذا توضأ فأحسن الوضوء ثم أتى المسجد لا يريد إلا الصلاة، لا ينهزه إلا الصلاة، لم يخط خطوة إلا رفع له بها درجة، وحط عنه بها خطيئة حتى يدخل المسجد، فإذا دخل المسجد كان في صلاة ما كانت الصلاة تحبسه، والملائكة تصلي على أحدكم ما دام في مجلسه الذي صلى فيه، يقولون: اللهم اغفر له، اللهم ارحمه، ما لم يحدث فيه، ما لم يؤذ فيه.'”

উচ্চারণ: “আন আবি হুরাইরাহ (রা.) কাল: কালা রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘সালাতুর রিজালু ফিল জামাআতু তাজিদু আলা সালাতিহি ফিসুকিহি ওয়াবাইতিহি বিদা’ও ওয়াশরিন দারাজাত, ওয়াযালিকা আন আহাদুহুম ইযা তাওয়াদ্দা’ ফা-আহসানাল উজু’ সুম্মা আতাল মাসজিদা লা ইউরিদু ইল্লা সালাত, লা ইয়ানহুযুহু ইল্লা সালাত, লাম ইয়াখতু খাতু’আ ইল্লা রুফিআ লাহু বিহা দারাজাত, ওয়া হুতত আনহু বিহা খাতিয়াত হত্তা ইয়াদখুলাল মাসজিদ, ফা ইযা দাখালাল মাসজিদা কান ফি সালাত মা কানাত সালাতু তুহবিসুহ, ওয়াল মালাইকা তুসাল্লি আলা আহাদিকুম মা দামা ফি মজলিসিহিল্লাযি সাল্লা ফিহ, ইয়াকুলুন: আল্লাহুম্মাগফির লাহু, আল্লাহুম্মারহামহু, মা লাম ইউহদিস ফিহ, মা লাম ইউযি ফিহ.'”

অর্থ: “আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘লোকদের মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া তার ঘর ও বাজারের নামাজের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সওয়াবদায়ক। কারণ, সে যদি উত্তমভাবে ওজু করে মসজিদে যায় শুধুমাত্র নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে, তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং একটি পাপ মুছে ফেলা হয় যতক্ষণ না সে মসজিদে প্রবেশ করে। যখন সে মসজিদে প্রবেশ করে, তখন সে নামাজের মধ্যে থাকে যতক্ষণ না নামাজ শেষ হয়। এবং ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে, তারা বলে: আল্লাহুম্মা তার জন্য ক্ষমা করো, আল্লাহুম্মা তার প্রতি দয়া করো, যতক্ষণ না সে ক্ষতি করে অথবা কাউকে কষ্ট দেয়।'” (মুসলিম)

 

হাদিস:

আরবি: “عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: ‘مَنْ غَسَّلَ وَاغْتَسَلَ، وَبَكَّرَ وَابْتَكَرَ، وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ، وَدَنَا مِنَ الإِمَامِ فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ، كَانَ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ، أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا.'”

উচ্চারণ: “আন আবি সাঈদিল খুদরি (রা.), আন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কাল: ‘মান গাসালা ওয়াগতাসালা, ওয়াবাক্কারা ওয়াবতাকারা, ওয়ামাশা ওয়ালাম ইয়ারকাব, ওয়াদানা মিনাল ইমামি ফাসতামা’ ওয়ালাম ইয়ালগ, কান লাহু বিকুল্লি খাতু’আ আমালু সানাহ, আজরু সিয়ামিহা ওয়া কিয়ামিহা.'”

অর্থ: “আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের দিন গোসল করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের গোসল করায়, এবং তাড়াতাড়ি মসজিদে যায়, এবং গাড়ি ব্যবহার না করে পায়ে হেঁটে যায়, এবং ইমামের কাছে গিয়ে মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনে এবং নিরব থাকে, তার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে এক বছরের আমলের সওয়াব, যার মধ্যে রোজা এবং কিয়াম (রাতের নামাজ) অন্তর্ভুক্ত।'” (তিরমিজি)

ঈদের নামাজের ফজিলত সম্পর্কে এই কুরআন এবং হাদিসগুলো আমাদের স্পষ্ট ধারণা দেয় এবং মুসলমানদের এই গুরুত্বপূর্ণ নামাজ আদায়ে উৎসাহিত করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ফজিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন

 

ঈদের নামাজ না পড়লে কি গুনাহ?

ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এই নামাজ আদায় না করে, তবে তা গুনাহের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদের নামাজ আদায় করবে না, সে আমাদের পথ অনুসরণ করছে না।” (তিরমিজি)

 

ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম

১. ঈমামের সঙ্গে তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উভয় হাত বাঁধা। 

২. তাকবিরে তাহরিমার পর ছানা পড়া: ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।’ 

৩. অতিরিক্ত ৩ তাকবির দেওয়া। 

৪. প্রতিটি তাকবিরের মধ্যে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় বিরত থাকা। 

৫. সুরা ফাতেহা পড়া এবং সুরা মিলানো। 

৬. প্রথম রাকাতের নিয়মিত রুকু ও সেজদা করা। 

৭. দ্বিতীয় রাকাতে একইভাবে অতিরিক্ত ৩ তাকবির দেওয়া। 

৮. রুকুর তাকবির দিয়ে রুকুতে যাওয়া এবং সেজদা করা। 

৯. তাশাহহুদ, দরূদ এবং দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরানো।

 

কাদের জন্য ঈদের নামাজ ওয়াজিব?

ঈদের নামাজ সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষ ও নারীর জন্য ওয়াজিব। বিশেষত, পুরুষদের জন্য এটি জামাতে আদায় করা আবশ্যক। 

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদের নামাজ আদায় করবে, সে আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত হবে।” (বুখারী)

 

উপসংহার

ঈদের নামাজ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যম এবং মুসলিম একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিফলন। সঠিক নিয়ম মেনে ঈদের নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।

 

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ):

১. ঈদের নামাজ কত রাকাত? 

ঈদের নামাজ দুই রাকাত।

 

২. ঈদের নামাজের সময় কখন? 

ঈদের নামাজ সকাল বেলা, সূর্য ওঠার পর থেকে যোহরের আগ পর্যন্ত আদায় করা হয়।

 

৩. ঈদের নামাজের আগে কি খুতবা দেওয়া হয়? 

না, ঈদের নামাজের পর ইমাম খুতবা দেন।

 

৪. ঈদের নামাজ কি ঘরে আদায় করা যায়? 

হ্যাঁ, তবে সুন্নত হলো ঈদের নামাজ জামাতে ঈদগাহে আদায় করা।

 

৫. ঈদের নামাজে কত তাকবির দেওয়া হয়? 

প্রথম রাকাতে ৩ অতিরিক্ত তাকবির এবং দ্বিতীয় রাকাতে ৩ অতিরিক্ত তাকবির দেওয়া হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়মে ঈদের নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

আরো পড়ুন

হজ পালনের সম্পূর্ণ গাইড: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ম-কানুন

তাওবা গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি: খাঁটি তাওবার শর্ত এবং বাস্তবায়নের কৌশল