ভূমিকা

মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় দায়িত্ব হলো জানাজার নামাজ। জানাজার নামাজ হলো মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার। মুসলমানদের জন্য এটি ফরজে কিফায়া, অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক এই নামাজ আদায় করলে বাকিদের থেকে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এই নিবন্ধে জানাজার নামাজের পদ্ধতি, রীতি ও দোয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

 

জানাজার নামাজের গুরুত্ব

জানাজার নামাজের গুরুত্ব অনেক। মৃত ব্যক্তির জন্য জানাজার নামাজ একটি সুপারিশ হিসেবে কাজ করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ ۖ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ” (সূরা তাওবা, আয়াত ৮৪)

অর্থ: “তাদের কেউ মারা গেলে তাদের জানাজা নামাজ আদায় করো না এবং তাদের কবরের কাছে দাঁড়িয়ো না। তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তারা মৃত্যুবরণ করেছে ফাসিক অবস্থায়।”

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন একজন মুসলমানের জানাজার নামাজে ৪০ জন লোক উপস্থিত হয়, যারা আল্লাহর সাথে কোনো অংশীদার স্থাপন করেনি, আল্লাহ তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন।” (মুসলিম, হাদিস: ২১৮৪)

 

জানাজার নামাজের ফজিলত এবং কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ

জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করলে অনেক ফজিলত পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: 

“وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ” (সূরা তাওবা, আয়াত ১০৩)

অর্থ: “আর তুমি তাদের জন্য দোয়া করো। তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তি। আর আল্লাহ শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।”

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করে এবং দাফন না হওয়া পর্যন্ত থাকে, তার জন্য দুই কিরাত পরিমাণ সওয়াব রয়েছে। প্রতিটি কিরাত উহুদের সমান।” (বুখারি, হাদিস: ১৩২৫)

 

জানাজার নামাজ না পড়লে কি গুনাহ?

জানাজার নামাজ না পড়লে ফরজে কিফায়ার দায়িত্ব পূর্ণ হয় না। তাই এ নামাজ আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ মারা গেলে তার জানাজা নামাজ আদায় করো।” (মুসলিম, হাদিস: ৯৬৭)

 

জানাজার নামাজের পদ্ধতি

জানাজার নামাজের সঠিক নিয়ম হলো:

১. ইমামের অবস্থান: ইমাম মৃত ব্যক্তির বুক বরাবর দাঁড়াবে। (বুখারি, হাদিস: ১২৪৬)

 

২. মুক্তাদিদের কাতার: ইমামের পেছনে মুক্তাদিদের কাতার হবে। (ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৩১০২)

 

৩. নিয়ত: সবাই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে জানাজার ফরজ আদায়ের নিয়ত করবে। (বুখারি, হাদিস: ১)  জানাজার নামাজের ফরজ আদায়ের নিয়ত আরবিতে:

نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ صَلَاةَ الْجَنَازَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ للهِ تَعَالَى

উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া ছালাতাল জানাযাতা ফার্দাল কিফায়াতি লিল্লাহি তা’আলা

অর্থ: আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ত করছি।

 

৪. প্রথম তাকবির: তাকবিরে তাহরিমা (اَللهُ اَكْبَر) বলে কান পর্যন্ত হাত উঠাবে।

 

৫. ছানা পড়া:

سُبْحَانَكَ اَللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَلاَ اِلَهَ غَيْرُكَ

উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা, ওয়া তাআলা ঝাদ্দুকা ওয়া ঝাল্লা ছানাউকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি সমস্ত ত্রুটি থেকে পবিত্র। আপনার প্রশংসা ও বারকত অমসৃণ এবং আপনার নাম মঙ্গলময়। আপনার মহত্ব অতি মহান এবং আপনার প্রশংসা সর্বোচ্চ। আপনার বিপরীতে অন্য কোন মাবুদ নেই।

 

৬. দ্বিতীয় তাকবির ও দরুদ পাঠ:

اللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدُ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ

 

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদিউঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা ছাল্লাইতা আলা ইবরা-হিমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক আলা মুহাম্মাদিউঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হিমা ওয়া আলা আ-লি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।

 

বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিম আলাইহি সালামের পরিবারবর্গের ওপর শান্তি বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করুন, যেমন আপনি ইবরাহিম আলাইহি সালাম এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত।

 

৭. তৃতীয় তাকবির ও দোয়া:

 

মৃত ব্যক্তি যদি বালেগ পুরুষ বা নারী হয় তবে এই দোয়া পড়া:

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا، وَمَيِّتِنَا، وَصَغِيرِنَا، وَكَبِيرِنَا، وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا، وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا، اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِيمَانِ، وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِسْلَامِ، اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ، وَلَا تُضِلَّنَا بَعْدَهُ

 

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লি হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়েবিনা ওয়া ছগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া জাকারিনা ওয়া উংছানা, আল্লাহুম্মা মান আহয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইমান ওয়া মান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলাল ইসলাম। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আঝরাহু ওয়া লা তুদিল্লানা বাদাহু।

 

অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত এবং মৃতদের, উপস্থিত এবং গায়েবদের, ছোট ও বড়দের এবং আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাকে জীবিত রাখবেন তাকে ইসলামের ওপরই জীবিত রাখুন। যাকে মৃত্যু দান করবেন তাকে ইমানের সাঙ্গেই মৃত্যু দিন। হে আল্লাহ! এর সাওয়াব থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না এবং এর পর আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন না। (আবু দাউদ ৩২০১, তিরমিজি ১০২৪)

 

মৃত যদি ছেলে শিশু হয় তবে এই দোয়া পড়া:

اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرَطًاً , وَّاجْعَلْهُ لَنَا أَجْرًا وَّذُخْرًا , اَللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا شَفِيْعًا وَّمُشَفَّعًا

 

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজআলহু লানা ফারাতঁও ওয়াজআলহু লানা আজরাঁও ওয়া জুখরাঁও ওয়াজআলহু লানা শা-ফিআও ওয়া মুশাফ্ফাআ।

 

অর্থ: হে আল্লাহ! এ বাচ্চাকে আমাদের নাজাত ও আরামের জন্য আগে পাঠিয়ে দাও, তার জন্য যে দুঃখ তা আমাদের প্রতিদান ও সম্পদের কারণ বানিয়ে দাও, তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী বানাও, যা তোমার দরবারে কবুল হয়।

 

মেয়েশিশু হলে এই দোয়া পড়া:

اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرَطًاً , وَّاجْعَلْهَا لَنَا أَجْرًا وَّذُخْرًا , اَللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا شَفِيْعَةً وَّمُشَفَّعَة

 

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজআলহা লানা ফারাতঁও ওয়াজআলহা লানা আজরাঁও ওয়া জুখরাঁও ওয়াজআলহা লানা শা-ফিআতাঁও ওয়া মুশাফ্ফাআহ।

 

অর্থ: হে আল্লাহ! এ বাচ্চাকে আমাদের নাজাত ও আরামের জন্য আগে পাঠিয়ে দাও, তার জন্য যে দুঃখ তা আমাদের প্রতিদান ও সম্পদের কারণ বানিয়ে দাও, তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী বানাও, যা তোমার দরবারে কবুল হয়।

 

৮. চতুর্থ তাকবির ও সালাম: চতুর্থ তাকবির বলে ডান ও বাম দিকে সালাম ফেরাবে। (দারাকুতনী ১৮৫৩, ইবনে আবি শায়বা ৩/২৯৫)

জানাযা নামাজ শিশুদের জন্য দোয়া

اللَّهُمَّ أَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْر

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আইযহু মিন আযাবিল কবরি।

 

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি এ ছেলেটিকে কবর আজাব থেকে রক্ষা করো। (মিশকাত ১৬৮৯)

 

اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا سلفا وفرطا وذخرا وَأَجرا

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাজআলহু লানা সালাফান ওয়া ফারাত্বান ওয়া যুখরান ওয়া আজরান।

অর্থ: হে আল্লাহ! এ ছেলেটিকে (কেয়ামতের দিন) আমাদের অগ্রবর্তী ব্যবস্থাপক, রক্ষিত ভান্ডার ও সওয়াবের কারণ বানাও। (মিশকাত ১৬৯০)

 

যদি দোয়া দুইটি কারো জানা না থাকে:

اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَات

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লিলমু’মিনিনা ওয়াল মু’মিনাত।

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি মুমিন নারী-পুরুষ উভয়কে ক্ষমা করে দিন।

জানাজার নামাজ পড়ার সময়

জানাজার নামাজ আদায়ের জন্য কোন বিশেষ সময় নির্দিষ্ট নেই। তবে সূর্যোদয়, সূর্য মধ্যগগনে অবস্থান এবং সূর্যাস্তের সময় নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকতে হয়। (তিরমিজি, হাদিস: ১০৩১)

উপসংহার

জানাজার নামাজ মৃত ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি মুসলমানদের ওপর ফরজে কিফায়া। নামাজের নিয়ম-কানুন এবং দোয়াগুলো জানা এবং সঠিকভাবে পালন করা আমাদের দায়িত্ব।

 

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

  • জানাজার নামাজ ফরজ না সুন্নাহ? 

জানাজার নামাজ ফরজে কিফায়া, অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক আদায় করলে বাকিদের দায়িত্ব শেষ হয়।

  • জানাজার নামাজ কত রাকাত? 

জানাজার নামাজের রাকাত নেই, এটি চার তাকবিরে আদায় করা হয়।

  • মেয়েদের জানাজার নামাজ পড়তে পারবে কি? 

হ্যাঁ, মেয়েরা জানাজার নামাজ পড়তে পারে।

  • জানাজার নামাজে কতজন লোক থাকতে হবে? 

জানাজার নামাজে কমপক্ষে তিনজন লোক থাকতে হবে। যত বেশি লোক থাকবে ততই ভালো।

  • জানাজার নামাজ কোন সময় পড়তে হয় না? 

সূর্যোদয়, সূর্য মধ্যগগনে অবস্থান এবং সূর্যাস্তের সময় জানাজার নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে হয়।

 

আরো পড়ুন

হজ পালনের সম্পূর্ণ গাইড: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ম-কানুন

ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম ও নিয়ত: তাকবিরের গুরুত্ব